জিনজিরা, ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত এই এলাকাটি ‘মেইড ইন জিনজিরা’ নামে বেশি পরিচিত। এই নামটি পেয়েছে মূলত এখানকার ব্যাপক নকল পণ্য উৎপাদনের কারণে। মেশিনারিজ, গাড়ির যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে প্রসাধনী—কীই বা উৎপাদন হয় না এখানে! শুধু তা-ই নয়, নকল খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রেও জিনজিরার জুড়ি মেলা ভার।
রমজান মাসকে সামনে রেখে জিনজিরায় এখন তৈরি হচ্ছে নকল ট্যাং, জুস ও গ্লুকোজ। স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি জেনেও প্রশাসন যেন কিছুই জানেন না এমন ভাব দেখাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এই নকল ও ভেজাল খাদ্যসামগ্রী দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করছে। মফস্বল এলাকার গ্রাহকরা এসব নকল পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন এবং মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।
আরও পড়ুন:মসজিদে জুতা হারানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ১০ জন
চিকিৎসকদের মতে, এই ভেজাল পণ্যগুলো মানবদেহের পাকস্থলি ও ফুসফুসে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
ঢাকার কেরাণীগঞ্জের জিনজিরা, মান্দাইল, আমিরাবাগ, বোরহানিবাগ, শুভঢ্যা, আগানগর, কালিগঞ্জ ও কাজিরগাও এলাকায় রমজান মাসকে কেন্দ্র করে নকল ও ভেজাল অরেঞ্জ জুস, ম্যাংগো ড্রিঙ্কস পাউডার (ট্যাংক) এবং নামিদামি কোম্পানির মোড়কে কিটকাট, মিমিসহ বিভিন্ন ধরনের চকলেট তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কেরাণীগঞ্জ উপজেলার পার্শ্ববর্তী গদাবাগ, মুক্তির বাগ, আমিরাবাগ, নেকরোজ বাগ, খোলামোড়া জিয়ানগর, তেঘরিয়া, শুভাঢ্যা, আগানগর, কালিগঞ্জ, কাজিরগাও ও আব্দুল্লাহপুর এলাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভেজাল ও নকল শিশু খাদ্য তৈরি করে চাতুর্যের সঙ্গে বাজারজাত করা হচ্ছে।
মুক্তিরবাগ এলাকায় একটি কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন নারী শ্রমিক হাতে বোতলে ভেজাল ও নকল পণ্য ভরছেন। তাদের হাতে কোনো গ্লাভস নেই, মাথায় টুপিও নেই। অরেঞ্জ ড্রিংকস পাউডার বোতলজাত করার সময় ফ্যান বন্ধ রাখা হয়েছে যাতে পাউডার বাতাসে উড়ে না যায়। এতে শ্রমিকরা ঘেমে একেবারে ভিজে গেছেন। এক নারী শ্রমিক হাত দিয়েই ড্রিংকস পাউডার বোতলে ভরছেন—এমন দৃশ্যও চোখে পড়ে।
সেখানে কারখানার ম্যানেজার শাকিল আহমেদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, তাদের বিএসটিআই ও পরিবেশগত ছাড়পত্র আছে, তবে তা দেখাতে পারেননি। ল্যাব আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি স্বীকার করেন যে ল্যাব নেই। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে রেসিপি আছে, সেটা অনুযায়ী আমরা ড্রিংকস পাউডার তৈরি করি এবং দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠাই। পরে আমাদের বিক্রয় প্রতিনিধিরা পণ্যগুলো বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন।”
এই ভেজাল ও কৃত্রিম রং মিশ্রিত অরেঞ্জ ড্রিংকস স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর জানতে চাইলে শাকিল আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের আবহাওয়া খুবই ভালো, এখানে সবকিছুই হজম হয়ে যায়। কয়েক বছর ধরে আমরা এই পণ্য বাজারে বিক্রি করছি, কিন্তু কখনো কোনো সমস্যার কথা শুনিনি।”
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রজিনা আমিন বলেন, “কৃত্রিম রং মিশ্রিত ভেজাল ড্রিংকস স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো লিভার ও কিডনিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং শরীরে ইনসুলিনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ছোট শিশুদের জন্য এগুলো আরও বেশি বিপজ্জনক, কারণ এতে চিনির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। রমজান মাসে রোজাদারদের পানির চাহিদা পূরণ করতে জুস অপরিহার্য। তবে ঘরে তৈরি দেশীয় ফলের জুস পান করাই সবচেয়ে ভালো।”
কেরাণীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর শাহিনুর রহমান বলেন, “আমরা খবর পেয়েছি যে অসাধু ব্যবসায়ীরা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে অবৈধভাবে অরেঞ্জ ড্রিংকস পাউডার তৈরি করছে। এসব কারখানায় অভিযান চালাতে আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিলেই আমরা অভিযান শুরু করব।”
কেরাণীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিনাত ফৌজিয়া বলেন, “ভেজাল খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা একটি বড় অপরাধ। আমরা দ্রুতই ভেজাল ও নকল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাব।”
