ধর্ষণ একটি গম্ভীর অপরাধ, এবং যখন কেউ ধর্ষণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনায় থাকে, তখন আত্মরক্ষার অধিকার তার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। প্রশ্ন উঠে, ধর্ষণের চেষ্টা চলাকালে ভুক্তভোগী কি অপরাধীকে আঘাত করতে বা মারতে পারেন? এই প্রশ্নে বাংলাদেশের আইন এবং আন্তর্জাতিক আইন কী বলে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের আইনে আত্মরক্ষা
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৯৬ থেকে ১০৬ ধারায় আত্মরক্ষার অধিকার স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ নিজেকে বা অন্যকে গুরুতর শারীরিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় বল প্রয়োগ করেন, তবে এটি আত্মরক্ষা হিসেবে গণ্য হবে এবং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না।
কখন প্রাণঘাতী আঘাত বৈধ?
দণ্ডবিধির ১০০ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ নিজের জীবন বা গুরুতর শারীরিক ক্ষতির ভয় থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রাণঘাতী আঘাত করেন, তবে সেটি বৈধ আত্মরক্ষা হিসেবে গণ্য হবে। এই ধারা অনুযায়ী কিছু পরিস্থিতি রয়েছে, যেখানে আত্মরক্ষার জন্য প্রাণঘাতী আঘাত বৈধ হতে পারে:
১. যদি কেউ ভুক্তভোগীর শারীরিক সম্মান ক্ষুণ্ন করতে আসে (যেমন ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি)।
২. যদি অপরাধী প্রাণনাশের হুমকি দেয় বা অস্ত্রসহ আক্রমণ করে।
৩. যদি ভুক্তভোগী আত্মরক্ষা না করলে গুরুতর আহত বা নিহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ধর্ষণের চেষ্টা সরাসরি ভুক্তভোগীর জীবন এবং মর্যাদার ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা হয়। অতএব, যদি ভুক্তভোগী আত্মরক্ষায় অপরাধীকে মারাত্মক আঘাত করেন বা তাকে হত্যা করেন, তবে সেটি আত্মরক্ষা হিসেবে গণ্য হবে এবং সাধারণত ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না।
আত্মরক্ষার সীমা
আইন আত্মরক্ষার অধিকার দিলেও এটি অবশ্যই 'যথাযথ বলপ্রয়োগ' হতে হবে। অর্থাৎ, ভুক্তভোগী কেবলমাত্র ততটুকু বল প্রয়োগ করতে পারবেন যা তার জীবন রক্ষায় অপরিহার্য, অতিরিক্ত আক্রমণ বা প্রতিশোধপরায়ণ আচরণ আইনের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করলে তা কখনো কখনো ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
আন্তর্জাতিক আইনে আত্মরক্ষা
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো আত্মরক্ষার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো নারীদের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করে। ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে, যদি একজন ব্যক্তি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং অপরাধী আহত বা নিহত হন, তবে এটি অধিকাংশ আইনে বৈধ আত্মরক্ষা হিসেবে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের আইনের প্রয়োগ
বাংলাদেশে আত্মরক্ষার অধিকার থাকলেও, বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ভুক্তভোগীদের আইনি প্রক্রিয়ায় সমস্যা হতে পারে। অনেক সময় পুলিশ বা আদালত আত্মরক্ষার যুক্তিকে উপেক্ষা করতে পারে, বিশেষ করে যদি ভুক্তভোগী নারী হন। তাই, এই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সঠিক আইনি সহায়তা পাওয়া জরুরি।
ধর্ষণের চেষ্টা চলাকালে, ভুক্তভোগী যদি আত্মরক্ষায় অপরাধীকে আঘাত করতে বা মারতে চান, তবে তা তার জীবন রক্ষায় অপরিহার্য হলে আইন তার পক্ষে কথা বলবে। বাংলাদেশের আইন এই অধিকার স্বীকার করে, তবে আত্মরক্ষার মাত্রা 'যথাযথ' হতে হবে। আত্মরক্ষা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
